রমযান মাসে আমাদের যা করনীয়****

আমরা যখন এ মাসের গুরুত্ব অনুভব করলাম তখন আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল কীভাবে এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো যায় সে প্রচেষ্টা চালানো। এ মাসে হেদায়াতের আলোকবর্তিকা আল-কোরআন নাজিল হয়েছে। এ মাসে
জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। একজন ঘোষণাকারী ভাল কাজের আহ্বান জানাতে থাকে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলে। সাথে সাথে এটা হল মাগফিরাতের মাস, জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস। এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদর যা হাজার মাস থেকে শ্রেষ্ঠ। আমাদের অনেকের ধারণা রমজান মাস সিয়াম পালন ও তারাবীহ আদায়ের মাস। ব্যাস ! আর কীসের আমল ? দিনের বেলা পানাহার থেকে বিরত থাকছি এটা কম কি? না, ব্যাপারটা শুধু এ টুকুতে সীমিত নয়। রমজান একটি বিশাল বিদ্যাপীঠ। এ রমজানে আমরা কি কি নেক আমল করতে পারি তা নিম্নে আলোচনা করা হল :—
(১) কিয়ামুল লাইল কিয়ামুল লাইল শব্দের অর্থ রাতের সালাত। অর্থাৎ সালাতে তারাবীহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :—
Quote

من قام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه. رواه مسلم

যে রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রাতে সালাত আদায় করবে তার অতীতের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। বর্ণনায় : মুসলিম সালাতে তারাবীহ যেমন কিয়ামুল লাইলের মধ্যে পড়ে তেমনি শেষ রাতে তাহাজ্জুদও সালাতুল লাইল এর অন্তর্ভুক্ত। ইমাম সাহেবের সাথে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জামাতে সালাত আদায় করলে রমজানের পূর্ণ রাত সালাত আদায়ের সওয়াব অর্জিত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
Quote

من قام مع الإمام حتى ينصرف كتب له قيام ليلة (رواه أبو داود)

ইমাম সাহেব সালাত শেষ করা পর্যন্ত তার সাথে যে সালাত আদায় করবে সে পূর্ণ এক রাত সালাত আদায়ের সওয়াব পাবে। বর্ণনায় : আবু দাউদ যে সামর্থ্য রাখে সে ইমামের সাথে সালাত শেষ করে একা একা যত ইচ্ছা তত সালাত আদায় করবে। এ ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে যে অমনোযোগিতা দেখা যায় তা হল রমজানের প্রথম রাতে তারা সালাতে অংশ নিতে পারে না। আবার অনেককে রমজানের শেষ দিকে অলসতায় পেয়ে বসে। ফলে তারা পূর্ণ রমজানের কিয়ামুল লাইলের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন।
(২) আল-কোরআন খতম ও তিলাওয়াত : নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
Quote

الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة . . .

সিয়াম ও কোরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে...। হাদিসে এসেছে, রমজানে জিবরাইল রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কোরআন পাঠ করে শোনাতেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পূর্ণ কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে জিবরাইলের কাছে তুলে ধরতেন। আল-কোরআন তিলাওয়াত হল সর্বশ্রেষ্ঠ জিকির। সিয়াম পালনকারী এ জিকির থেকে বঞ্চিত থাকতে পারেন না। আল-কোরআন তিলাওয়াতের একটি সঠিক দিক-নির্দেশনামুলক প্রবন্ধ এ বইয়ের শেষ দিকে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। পাঠক এ থেকে উপকৃত হতে পারবেন। যদি কেউ কোরআন তিলাওয়াত করতে অপারগ হন তাহলে বিভিন্ন তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ আদায়ের মাধ্যমে মুখে আল্লাহর জিকির অব্যাহত রাখবেন।
(৩) সদকা বা দান : প্রখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন :—
Quote

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم أجود الناس بالخير، وكان أجود ما يكون في شهر رمضان. رواه مسلم

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমজানে তার বদান্যতা আরো বেড়ে যেত। বর্ণনায় : মুসলিম ইমাম শাফেয়ি (র.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করে তার উম্মতের জন্য উত্তম কাজ হল রমজান মাসে তারা বেশি করে দান-সদকা করবে। কারণ এ মাসে মানুষের প্রয়োজন বেশি থাকে। অপরদিকে রমজান হল জিহাদের মাস। তাই প্রত্যেকের উচিত অর্থ-সম্পদ দান করার মাধ্যমে জিহাদে অংশ নেয়া।
(৪) এতেকাফ :— ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :—
Quote

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف العشر الأواخر من رمضان . رواه مسلم

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন। বর্ণনায় ; মুসলিম। এতেকাফ প্রসঙ্গে ইমাম যুহরি বলেন, আশ্চর্যজনক হল মুসলমানরা এতেকাফ পরিত্যাগ করে অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আসার পর থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত কখনো এতেকাফ পরিত্যাগ করেননি।
(৫) ওমরাহ আদায় :— যেমনটি হাদিসে এসেছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
Quote

عمرة في رمضان كحجة معي

রমজান মাসে ওমরাহ আদায় আমার সাথে হজ আদায়ের সমতুল্য।
(৬) রোজাদারদের ইফতার করানো : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
Quote

من فطر صائما كان له مثل أجره ، غير أنه لا ينقص من أجر الصائم شيئا. رواه أحمد
যে ব্যক্তি কোন সিয়াম পালনকারীকে (রোজাদারকে) ইফতার করাবে সে সিয়াম পালনকারীর অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে, তবে তাতে সিয়াম পালনকারীর সওয়াব বিন্দুমাত্র কমে যাবে না। বর্ণনায় : আহমদ

(৭) দোয়া-প্রার্থনা করা : আল্লাহ রাব্বুল সিয়ামের বিধান বর্ণনা করার পর বলেছেন -
Quote

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ (البقرة : 186)
আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দেই। [সূরা আল-বাকারা : ১৮৬]

তাই সিয়াম পালনকারী আল্লাহর কাছে অধিক পরিমাণে দোয়া-প্রার্থনা করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
Quote

ثلاث دعوات مستجابة : دعوة الصائم، دعوة المظلوم، دعوة المسافر. رواه البيهقي في شعب الإيمان وصححه الألباني في الجامع
তিনজনের দোয়া কবুল করা হয় ; সিয়াম পালনকারীর দোয়া, অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া এবং মুসাফিরের দোয়া। সহি আল-জামে (৮)

তওবা করা : সর্বদা তওবা করা ওয়াজিব। বিশেষ করে এ মাসে তো বটেই। এ মাসে তওবার অনুকূল অবস্থা বিরাজ করে। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নাম থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়া হয়। এ ছাড়া রমজান মাসের সকল ইবাদত বন্দেগি তওবার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
Quote

رغم أنف رجل دخل عليه رمضان، ثم انسلخ قبل أن يغفر له (رواه الترمذي)
যে ব্যক্তি রমজান মাস পেয়েও তার পাপ ক্ষমা করাতে পারেনি তার নাক ধুলায় ধূসরিত হোক। বর্ণনায় : তিরমিজি

তাই রমজান মাসটাকে তওবা ও ক্ষমা পাওয়ার মাস হিসেবে গ্রহণ করে সে অনুযায়ী আমল করা উচিত।
(৯) নেক আমল করতে অধিক হারে চেষ্টা অব্যাহত রাখা: বিশেষ করে রমজানের শেষ দশকে -
Quote

عن عائشة رضي الله عنها قالت : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا دخل العشر أحيى الليل، وأيقظ أهله، وجد وشد المئزر. رواه مسلم
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : যখন রমজানের শেষ দশক এসে যেত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন রাত্রি জাগরণ করতেন, পরিবারবর্গকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দিতেন, লুঙ্গি শক্ত ও ভাল করে বেঁধে (প্রস্তুতি গ্রহণ) নিতেন। বর্ণনায় : মুসলিম

তিনি আরো বলেন :—
Quote

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يجتهد في العشر الأواخر ما لا يجتهده في غيره. رواه مسلم
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইবাদত-বন্দেগিতে যে পরিশ্রম করতেন অন্য সময় এ রকম করতেন না। বর্ণনায় : মুসলিম

(১০) ইসলামি শিক্ষা অর্জনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান : ইসলামি শিক্ষা হল সকল প্রকার শিক্ষার মূল। তা ছাড়া দুটি বিষয় লক্ষ্য করা খুব জরুরি এক. ইসলামের সকল ইবাদত-বন্দেগি সঠিকভাবে আদায় করতে হলে ইসলামি শিক্ষা অর্জন করতে হয়। এ ব্যাপারে কোন ওজর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। সালাতের নিয়মকানুন, সিয়ামের বিধান, জাকাতের নিয়ম-নীতি, হজের আহকাম না শিখে এগুলো আদায় করা যায় না। দুই. আল-কুরআনের তফসির শেখা ও অধ্যয়ন অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে আমরা যে সকল সূরা-কেরাত সালাতের মাঝে পড়ে থাকি সেগুলোর মর্ম অনুধাবন করে তিলাওয়াত করা দরকার। কাজেই রমজান মাসকে আমরা ইসলামি শিক্ষা অর্জন ও শিক্ষা প্রসারের একটি সুযোগ হিসেবে নিতে পারি। মূর্খতার অবসান ঘটানো সিয়ামের একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
Quote

من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل، فليس لله حاجة أن يدع طعامه وشرابه . رواه البخاري
যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। বর্ণনায় : বোখারি

হাদিসটি দ্বারা স্পষ্ট বুঝে আসে যদি মূর্খতা পরিহার না করা হয় তবে সিয়াম আল্লাহর কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। আর মূর্খতা ত্যাগ করা যাবে শুধু শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে।